হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ৷

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ)-এর জীবনী আমাদের প্রত্যেকের জানা আবশ্যক। যারা অনেকেই হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) জীবনী সম্পর্কে জানবো জানবো  মনে করছেন। তাদের জন্য আমাদের এই পোস্টটি তাদের জন্য।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ৷

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ৷ তিনি ছিলেন উম্ম হাতুল ময়মিন। চলুন কথা না বাড়িয়ে তার সম্পর্কেে আমরা বিস্তারিত জানবা।

সূচিপত্র: হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ৷

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) তিনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর সর্বশেষ স্ত্রী ছিলেন ৷ তার পিতার নাম হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ৷ এবং মাতার নাম উম্মে রুমান বিনতে আমির। তার উপাধি ছিল হুমায়রা এবং সিদ্দিকা ৷ তার উপনাম ছিল উম্মুল মুমিনীন ৷

আরো পড়ুন: হযরত ওমর রা: জীবনী কাহিনী

তিনি হিজরতের পূর্বে ৬১৩ মতান্তরে ৬১৪ খ্রিস্টাব্দে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন ৷ কুরাইশ বংশের নিয়ম অনুযায়ী তার লালন পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওয়াইল নামক এক লোকের স্ত্রীর উপর ৷ তিনি তাকে শৈশব পর্যন্ত লালন পালন করেন৷
শৈশব কাল থেকে তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারিনী ৷ শিশুকাল থেকেই তার চাল-চলন, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, মেধা শক্তি সকলকে মুগ্ধ করেছিল ৷ শৈশব কাল থেকেই তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় ৷ তিনি শিক্ষা জীবনেও ছিলেন অগ্রগামী ৷ তার মধ্যে সর্বদাই শিশু চরিত্র বিদ্যমান ছিল ৷ শৈশব কাল থেকে তিনি খেলাধুলা, দৌড়াদৌড়ি, আমোদ ফুর্তি ভালোবাসতেন ৷ 
হযরত খাদিজা (রাঃ) ইন্তেকালের পর নবুওয়াতের দশম সনে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর সাথে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহার বিবাহ হয়৷ এই বিয়েতে ৪৮০ দিরহাম দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়৷ আর এই বিবাহর ঘটক ছিলেন হযরত খাওলা বিনতে হাকিম রাদিয়াল্লাহু আনহু ৷ 
বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহার যখন বিবাহ হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর ৷ আহলুল সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত ও হাদিস অনুযায়ী তার বয়স ছিল ৬/৭ বছর।

হযরত আয়েশা (রা) এর শিক্ষাজীবন

তৎকালীন আরব সমাজের লেখাপড়ার তেমন সুযোগ ছিল না ৷ তিনি তার পিতার কাছ থেকেই মূলত লেখাপড়া শুরু করেন ৷ তিনি সাহিত্য এবং ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন ৷ তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং বিচক্ষণ একজন নারী ছিলেন ৷ যা একবার শুনতেন তা দক্ষতার সাথে মুখস্ত করে ফেলতেন ৷ সাহিত্য ও ইতিহাস অর্জন ছাড়াও তিনি গৃহস্থলী বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন ৷ 

তিনটি কারণে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) আয়েশা (রাঃ) কে বিবাহ করেন

  • ১| আবু বক্কর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ করা ৷
  • ২| তিনি ছিলেন একজন অত্যান্ত মেধাবী নারী ৷ এই মেধাকে কাজে লাগানোর জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিবাহ করেন৷ এবং সমস্ত মহিলা বিষয়ক মাসয়ালা তার মাধ্যমে বর্ণিত হয় ৷
  • ৩| আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নযোগে আয়েশা (রাঃ) কে দেখান। এই ওহির নির্দেশে মহানবী হয়রত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশাকে বিবাহ করেন ৷

ব্যভিচারের অপবাদ

সূরা নূরে বর্ণিত আছে ৷ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজেই বর্ণনা করেন ৷ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিয়ম ছিল ৷ তিনি যখন কোন যুদ্ধ বা সফরে বের হতেন ৷ তখন তিনি স্ত্রীদের মধ্য থেকে কে তার সঙ্গী হবে তা ঠিক করার জন্য লটারি করতেন ৷ বনি মুস্তালিক যুদ্ধের সময় আমার নাম লটারিতে উঠে আসে ৷ ফলে আমি তার সঙ্গী হই ৷
ফেরার সময় আমরা যখন মদিনার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তখন এক মঞ্জিলে রাত্রিকালে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফেলার যাত্রা বিরোতী করেন ৷ এদিকে রাত পোহানোর কিছু সময় বাকি ছিল এমন সময় রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় ৷ আমি উঠে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য যাই ৷ 
ফিরে আসার সময় মনে হলো আমার গলার হারটি ছিড়ে কোথাও পড়ে গেছে ৷ আমি তার খোঁজে লেগে যায় ৷ ইতিমধ্যেই কাফেলা রওনা হয়ে যায় ৷ নিয়ম ছিল, রওনা হওয়ার সময় আমি নিজের হাওদায় বসে যেতাম এবং চারজন লোক মিলে সেটি উঠিয়ে উটের পিঠে বসিয়ে দিতো ৷ আমি সে সময় হালকা-পাতলা হওয়ার কারণে তারা বুঝতে পারেনি যে আমি হাওদায় বসে আছি কিনা ৷
তখন তারা না জেনে খালি হাওদা উটের পিঠে উঠিয়ে দিয়ে রওনা হয়ে যায় ৷ আমি হার নিয়ে ফিরে এসে দেখি সেখানে কেউ নেই ৷ কাজেই নিজের চাদর মুড়ি দিয়ে আমি সেখানেই শুয়ে পড়ি ৷ মনে মনে ভাবি, সামনের দিকে গিয়ে আমাকে হাওদার মধ্যে না পেয়ে তারা নিজেরাই খুঁজতে খুঁজতে আমার এখানে চলে আসবে ৷ এ অবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি ৷
সকালে সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল সালামী আমি যেখানে শুয়েছিলাম সেখান দিয়ে যেতে থাকেন ৷ তিনি আমাকে দেখেই চিনে ফেলেন ৷ কারণ পর্দার বিধান নাজিল হওয়ার পূর্বে তিনি আমাকে বহুবার দেখেন ৷ তিনি একজন বদর সাহাবী ছিলেন ৷ তার অভ্যাস ছিল দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা ৷ তিনি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ৷
তার কথা শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং ঘুম থেকে উঠে আমার মুখ চাদর দিয়ে ঢেকে নেই ৷ উট থামিয়ে সে দূরে সরে যায় ৷ আর আমি উটের পিঠে উঠে যাই ৷ আমি উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যাই এবং সে রশি ধরে টানতে থাকে ৷ এই ঘটনা ঘটার পর মদিনার ওলিগলিতে এ গুজব রটাতে থাকে যে, নবীর স্ত্রী ব্যভিচার করেছে ৷ কিন্তু আসলে আমি তা করিনি ৷ লোকজন আমার চরিত্রের মধ্যে কলঙ্ক লাগাতে থাকে।

যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি কলঙ্করটায়

হাদিসে বর্ণিত আছে, সে সময় সফওয়ানের উটের পিঠে চড়ে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা শিবিরে এসে পৌঁছেন এবং তিনি এভাবে পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন বলে জানা যায় তখন আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই চিৎকার করে ওঠে, আল্লাহর কসম, এই মহিলা নি ষ্কলংক অবস্থায় আসেনি ৷
নাও, দেখো তোমাদের নবীর স্ত্রী আর একজনের সাথে রাত কাটিয়েছে এবং সে এখন তাকে প্রকাশ্যে নিয়ে চলে আসছে ৷ মদিনায় পৌঁছে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা একমাস যাবত বিছানায় পড়ে থাকেন ৷ কিন্তু তিনি কিছুই জানতেন না ৷ এই মিথ্যা গুজব রোটাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে মুনাফিকের সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই ৷

ওহির মাধ্যমে মিথ্যা কলঙ্ক রটানোর সমাধান

সূরা নূর এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ত্রুটিমুক্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে ৷ আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই এই অপবাদ রটিয়ে একই গুলিতে কয়েকটি পাখি শিকার করার প্রচেষ্টা চালায় ৷ 
এদিকে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বক্কর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ইজ্জতের ওপর হামলা করে ৷ অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলনের উন্নততর নৈতিক মর্যাদা ও চারিত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করে ৷ এই সমস্যার সমাধান আল্লাহপাক সূরা নূরের মধ্যে ব্যাখ্যামূলক আলোচনা করেছেন ৷

এই ঘটনার পর থেকে নবী করীম (সঃ) এর পবিত্র স্ত্রীগণদের আদেশ দেওয়া হয়

  • ১| নিজেদের গৃহের মধ্যে মর্যাদা সহকারে বসে থাকো, সাজসজ্জা করে বাহিরে বের হয়ো না এবং ভিন পুরুষদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে বিনম্রসরে কথা বলো না, যাতে কোন ব্যক্তি কোন লাঞ্ছিত আশা পোষণ না করে ৷ ( সূরা নূর আয়াত  ৩২ ও ৩৩)
  • ২| নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গৃহে  ভিন পুরুষদের বিনা অনুমতিতে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নির্দেশ দেওয়া হয়, তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের কাছে কিছু চাইতে হলে পর্দার আড়াল থেকে চাইতে হবে ৷ ( সূরা নূর আয়াত ৫৩)
  • ৩| গায়রে মাহারাম পুরুষ ও মাহারাম আত্মীয়দের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং দেওয়া হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র স্ত্রীদের কেবলমাত্র স্বাধীনভাবে তার গৃহে যাতায়াত করতে পারবেন ৷( সূরা নূর আয়াত ৫৫)
  • ৪| মুসলমানদেরকে বলে দেওয়া হয়েছে ৷ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী তোমাদের জন্য মা এবং একজন মুসলমানের জন্য তারা চিরতরে ঠিক তার আপন মায়ের মতই হারাম ৷(সূরা নূর আয়াত ৫৩ ও ৫৪)
  • ৫| মুসলমানদেরকে এমন সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, নবী করিম (সঃ)কষ্ট দেয়া দুনিয়ায় ও আখিরাতে আল্লাহর লানত ও লাঞ্ছনা কর আসামের কারন হবে এবং এভাবে কোন মুসলমানের ইজ্জতের অপরাধ বহন করা এবং তার ভিত্তিতে তার ওপর অযথা দোষারোপ করা ও কঠিন গুনাহের শামিল। (সূরা নূর আয়াত ৫৭ ও ৫৮)
  • ৬/ সকল মুসলমান মেয়েকে হুকুম দেওয়া হয়েছে, যখনই বাহিরে বের হওয়ার প্রয়োজন হবে, চাদর দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে ডেকে এবং ঘোমটা টেনে বের হতে হবে ৷ ( সূরা নূর আয়াত ৫৯)

স্ত্রীদের জন্য আলাদা খরচ দিতেন

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সব স্ত্রীদের জন্য বার্ষিক চারশত মন খেজুর ৷ এবং একশত মন জব খরচের জন্য দিয়ে দিতেন ৷এই খাদ্য হতে তারা ইচ্ছামতো ভক্ষণ দান-খয়রাত মেহমানদারী করতেন ৷ 
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহার এর মেহমান বেশি এবং দানের পরিমাণ ও বেশি হওয়ায় তারই বেশি খাদ্য অভাব দেখা দেয় ৷ তিনি তার বাড়ির সামনে কোন ভিক্ষুক আসলে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না৷
এই রূপ অভাবের সংসারে তিনি কোনদিন স্বামীর নিকট বা পিতার নিকট কোন জিনিসের জন্য আবদার জানাতেন না বা কোন প্রকার অভিযোগ করতেন না ৷ বরং সারাদিন অনাহারে থাকলেও পারতপক্ষে তিনি কাউকে জানতে দিতেন না ৷
সংসারে এত পরিশ্রমের ভেতরও তিনি কখনোও নামাজ, রোজার প্রতি বিন্দুমাত্র অবহেলা প্রদর্শন করতেন না ৷ বছরের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে তিনি সিয়াম রাখতেন ৷ এবং ইসলামের খেদমতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিতেন ৷

হযরত আয়েশা (রাঃ) ইন্তিকাল

উম্মুল মু'মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা ৫৮ হিজরীর ১৭ই রমজান ৬৭৮খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুলাই ইন্তিকাল করেন ৷ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের পর ৪০ বছর পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন ৷ মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৬৪ বছর ৷ তাকে জান্নাতুল বাকি নামক কবরস্থানে সমাহিত করা হয় ৷


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফিউচার লাইফ আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url