গবাদি পশুর সংক্রমণ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন

গবাদি পশুর সংক্রমণ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন। যারা গবাদি পশুর সংক্রমণ রোগ নিয়ে চিন্তিত তাদেরকে আমাদের এই আর্টিকালের স্বাগতম। আমাদের এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে আশা করা যায়, আপনার গবাদি পশুর অকাল মৃত্যু হবে না। তাই আমাদের এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইল।

গবাদি পশুর সংক্রমণ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন

গবাদি পশুর কিছু সংক্রমণ রোগ এবং তার প্রতিকার সম্পর্কেও আমরা এই আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করব। যাই হোক কথা না বাড়িয়ে, চলুন মূল আলোচনা করা যাক। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ভূমিকা

আমরা কর্মসংস্থান ও দরিদ্র বিমোচনের উদ্দেশ্যে গবাদি পশু পাখি পালন করে থাকি। বাংলাদেশের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১০০০ মানুষের বসবাস। তারা বেশিরভাগই গবাদি পশু পাখি পালন করে থাকেন। কৃষি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ১০০ ভাগের প্রায় ৭৫ ভাগই মানুষ গবাদিপশু পাখি পালন করে থাকেন। আমাদের সঠিক পরিচর্যার অভাবে অনেক গবাদি পশুপাখির অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এজন্য চাই আমাদের সঠিক পরিচর্যা।

আমাদের বাংলাদেশে চিকিৎসা এবং সঠিক পরিচর্যার অভাবে প্রতিবছর প্রায় ১০% গবাদি পশুপাখির অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে হাঁস মুরগির পরিমাণ প্রায় ১৫%। এতে দেশের প্রচুর অর্থ নষ্ট হচ্ছে। এক কৃষি গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের গবাদি পশু পাখির মৃত্যুর কারণে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। নিম্নে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

গবাদি পশুর কিছু সংক্রমণ রোগ এবং তার প্রতিকার

সঠিক সময় গবাদি পশুর চিকিৎসা এবং টিকা প্রদান করতে হবে। এতে পশুর মৃত্যুর হার কমে আসবে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১। পশুর ক্ষুরা রোগ এবং তার চিকিৎসা
পশুর ক্ষুরা রোগ একটি সংক্রমণ ও ভাইরাস রোগ। এই রোগ মুখে এবং পায়ের ক্ষুরাতে আক্রান্ত হয়। ফলে পশু ভালো করে খেতে পারেনা এবং খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। মুখে রুচি না থাকার কারণে পশুর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পশুর এমনটি রোগ হয়ে থাকে। তবে আমাদের বাংলাদেশে এই সংক্রমণ রোগ বেশি হয়ে থাকে। যার ফলে অনেক পশুর মৃত্যুও ঘটে যায়।

পশুর ক্ষুরা রোগের জন্য বিভিন্ন ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। সেগুলো হল যেমন- মনো ভ্যালেন্ট, ট্রাইভ্যালেন্ট, ক্ষুরা ভ্যাক্স, আরিয়া FMD, বাংলা FMD, বাইভ্যালেন্ট ইত্যাদি।

ব্যবহার বিধিঃ ভ্যাকসিনের মাত্রা গরু এবং মহিষের ক্ষেত্রে মন ভ্যালেন্ট হলে ৩ মিলি, ট্রাই ভ্যালেন্ট ৯ মিলি, ক্ষুরা ভ্যাক্স ২ মিলি, বাংলা FMD ২ মিলি, আরিয়া FMD ২ মিলি ভেড়া এবং ছাগল হলে গরু ও মহিষের অর্ধেক ডোজ। এই ডোজ গুলো পশুর চার মাস বয়সে ঘাড়ের মাংসপেশীতে প্রয়োগ করতে পারবেন। এবং যতদিন পশু বাঁচবে ততদিন পর্যন্ত তিন অথবা চার মাস পরপর এই ডোজ প্রয়োগ করতে পারবেন।

২। পশুর তাড়কা রোগ এবং তার চিকিৎসা 
গবাদি পশুর মারাত্মক একটি রোগ হল তাড়কা রোগ এই রোগের লক্ষণ হল প্রথমে পশুর শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। প্রায় ১০৬ থেকে ১০৭ পর্যন্ত তাপমাত্রায় উন্নীত হয়। তখন পশুর শারীরিক অবস্থা অবনতি হতে থাকে। এই রোগের প্রাদুর্ভাবে পশুর নাক মুখ এবং মলদার দিয়ে রক্তপাত হয়। গবাদিপশু আস্তে আস্তে নিস্তেজ ও জমিনে পড়ে যায়। এই সময় পশুর পাতলা ও কালো পায়খানা শুরু হয়ে যায়।

ব্যবহার বিধিঃ (Anthrax vaccine) এই ভ্যাকসিন টি প্রত্যেক পশুর ক্ষেত্রে ৬ মাস বয়সে দিতে পারবেন। ভ্যাকসিন এর মাত্রা গরু এবং মহিষের ক্ষেত্রে ১ মিলি, ছাগল এবং ভেড়ার ক্ষেত্রে আধা মিলি। এই ভ্যাকসিন পশুর ঘাড়ের মাংসপেশিতে অথবা চামড়ার ভেতর পুশ করে প্রয়োগ করতে পারেন। প্রয়োগের সতর্কতা, এই ভ্যাকসিন টি ছয় সাত মাসের গর্ভবতী গরু এবং মহিষ কে দেওয়া যাবে না। তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের গর্ভবতী ছাগল ও ভেড়াকে প্রয়োগ করা যাবে না।

৩। পশুর বাদলা রোগ এবং তার চিকিৎসা
বাংলাদেশের গবাদি পশুর বর্ষাকালে এই রোগ হয় এজন্য এ রোগকে বাদলা রোগ বলে। এই রোগ সাধারণত ৬ মাস থেকে দুই বছরের গবাদি পশুর হয়ে থাকে। পশুর এই রোগ হয় ভেজা ঘাস খেলে, পুকুর বা নর্দমার ময়লা পানি পান ও গোসল করালে। এই রোগের বিস্তার তরকা রোগের মতো। এই রোগের লক্ষণ হল। মুখের রুচি হারিয়ে যাওয়া, এই রোগ আক্রান্ত হলে পশু খুরিয়ে খুরিয়ে  হাটে আকস্মিক মৃত্যু, পশুর শরীরে ১০৫ থেকে ১৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা, আক্রান্ত স্থান ফুলে যাওয়া। সেই জায়গাতে চাপ দিলে বুদবুদ আওয়াজ হওয়া, পশুর শরীর প্রচন্ড পরিমান ব্যথা হওয়া।

ব্যবহার বিধিঃ (Black Quarter) এই ভ্যাকসিন এর প্রথম ডোজটা শুরু করতে হয় গবাদি পশুর বয়স যখন ৬ মাস । এই ভ্যাকসিনটা ৬ মাস পরপর মোট ৩ বছর দিতে হবে। এরপর এ ভ্যাকসিনটি আর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগের মাত্রা গরু এবং মহিষের ক্ষেত্রে ৫ মিলি, ছাগল ও ভেড়ার জন্য মাত্র ২ মিলি। পশুর ঘাড়ের গভীর মাংসপেশিতে অথবা চামড়ার নিচে দিতে পারবেন।

৪। পশুর গলা ফুলা রোগ এবং তার চিকিৎসা
গলা ফুলা রোগ সাধারণত গরু এবং মহিষের হয়। এই রোগের লক্ষণ হল পশুর শরীরে ১০৫ থেকে ১০৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা হয়। পশুর গলা এবং শরীর প্রচন্ড ব্যথা হয়। গলা ফুলে থল থলে হয়ে যায়। হাত দিয়ে ফুলা স্থানে স্পর্শ করলে গরম অনুভূত হয় এবং ফুলা ক্রমশ বুক পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং শ্বাস ছাড়ার সময় ঘরঘর শব্দ হয়। জিহ্বা ফুলে যায় এবং সময় সময় মুখ হা করে শ্বাস-প্রশ্বাস চালায়। মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। মুখের রুচি না থাকার কারণে খাবার খায় না।

ব্যবহার বিধিঃ (Haemorrahagic Septicemia Vaccine) এই ভ্যাকসিন টি গবাদি পশুর বয়স যখন ৬ মাস তখন থেকে শুরু করতে হবে। এবং যতদিন পশু জীবিত থাকবে ততদিন পর্যন্ত ৬ মাস পর পর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ মাত্রা গরু এবং মহিষের জন্য ২ মিলি। ভেড়া এবং ছাগলের ক্ষেত্রে ১ মিলি। এটি পশুর গভীর ঘাড়ের মাংসপেশিতে অথবা চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হবে।

৫। পশুর জলাতঙ্ক রোগ এবং তার চিকিৎসা
জলাতঙ্ক রোগ হল এক ধরনের ভাইরাসজনিত রোগ। যা সংক্রমিত হয় এক ধরনের রেবিজ ভাইরাস নামক নিউরো ট্রপিক ভাইরাস থেকে। রেবিজ ভাইরাস বাদুর, শিয়ালের মাধ্যমে গৃহপালিত কুকুর ও বিড়ালকে প্রথমে সংক্রমিত করে। গবাদি পশু রেবিজ ভাইরাস আক্রান্ত কুকুরের লালা এর সংস্পর্শে আসলে অথবা কামড়, আঁচড় দিলে এই রোগ গবাদি পশুর মধ্যে ছড়াতে পারে।

জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণঃ প্রথম দিকে অনির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ যেমন জ্বর, ক্ষুধামন্দা, অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। কয়েক দিন পর থেকে অনিয়ন্ত্রিত উত্তেজনা, লালা রসের ক্ষরণ বৃদ্ধি দেখা দেয়। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো কোন কিছু গিলতে বা কোন কিছু গেলার সময় কন্ঠনালীর তীব্র ব্যথার সংকোচন হয়। বিশেষ করে পানি পান করার সময় এই সমস্যা বেশি হয়। এই সময় পশু ভীত সংকুচিত হয়। তাই এই রোগ কে জলাতঙ্ক রোগ বলে অবহিত করা হয়।

ব্যবহার বিধিঃ (Rabies Vaccine) জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের একটাই উপায় তা হলো ভ্যাকসিন দেওয়া। ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাত্রা বাছুর, ছাগল, ভেড়ার ক্ষেত্রে ১ মিলি করে পশুর তিন স্থানে প্রয়োগ করা। দ্বিতীয় মাত্রায় সপ্তম দিনে ১ মিলি করে দুই স্থানে প্রয়োগ করা। তৃতীয় মাত্রায় ২১ তম দিনে ১ মিলি করে দুই স্থানে প্রয়োগ করা।

প্রাপ্তবয়স্ক গরু এবং মহিষের ক্ষেত্রে ১ মিলি করে মোট চার মিলি চার স্থানে প্রয়োগ করতে হবে। সপ্তম দিনে এক মিলি করে মোট তিন মিলি তিন স্থানে প্রয়োগ করতে হবে। তৃতীয় মাত্রায় ২১তম দিনে মোট তিন মিলি তিন স্থানে এক মিলি করে প্রয়োগ করতে হবে।

৬। ছাগলের পিপিআর ভ্যাকসিন
ছাগল এবং ভেড়ার মরণ ভাইরাস পিপিআর। পিপিআর হল একটি ইংরেজি শব্দ। এর পূর্ণরূপ হল (Pests Des Petits Ruminants) এটি একটি সংক্রমণ রোগ। এই রোগ প্রতিটি গবাদি পশুর হয়ে থাকে। তবে এই রোগটি বেশি পরিলক্ষিত হয় ছাগল ও ভেড়ার উপর। এই ভাইরাস জনিত রোগের কারণে গবাদি পশুর মৃত্যু হয়।

এই রোগের লক্ষণ
এই রোগ গবাদি পশুর হলে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়। নিম্নে কয়েকটি লক্ষণের কথা উল্লেখ করা হলো।
  • পশুর শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ থেকে ১০৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়
  • মুখ দিয়ে পানি বের হয়
  • সেই পানি অথবা লালার রং হলুদ হয়
  • পশুর মুখে এক ধরনের ঘা হয়
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হয়
এই রোগের ভ্যাকসিন
এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাত্রা ছাগল এবং ভেড়ার জন্য ১ মিলি। ঘাড়ের গভীর মাংসপেশীতে অথবা চামড়ার নিচে এই ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা যায়। এই ভ্যাকসিন গবাদিপশুর চার মাস বয়স থেকে শুরু করতে হয়। উল্লেখ্য এই ভ্যাকসিন গর্ভবতী ভেড়া ও ছাগলের ১৫ দিন পূর্বে প্রয়োগ করা যাবে না।

গবাদি পশুর রোগ প্রতিরোধের কিছু কৌশল

গবাদি পশুর অকাল মৃত্যুর জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমাদের কিছু অসচেতনতার কারণে এমনটি হয়ে থাকে। এইজন্য আমাদের পশুর প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। নিম্নে গবাদি পশুর রোগ থেকে বাঁচার কিছু কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
  1. মানসম্মত পশুর বাসস্থান তৈরি
  2. পশুর বাসস্থান সর্বদাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা
  3. পশুর থাকার স্থান অর্থাৎ ঘরের মেঝে স্যাঁতস্যেতে না থাকা
  4. পশুর জন্য সুষম এবং পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা
  5. সঠিক মতো ভ্যাকসিন প্রদান করা
  6. অসুস্থ হলে সঠিক সময় চিকিৎসা করা
  7. কোন পশু সংক্রমণ রোগে আক্রান্ত হলে অথবা মৃত্যুবরণ করলে, সুস্থ পশুর কাছ থেকে দূরে রাখা।
  8. পশুর আবাসস্থলে বায়ু চলাচল নিশ্চিত করা
  9. বিশুদ্ধ খাদ্য এবং পানি নিশ্চিত করা
  10. পশুর নিয়মিত কৃমির ডোজ দেওয়া
উপরোক্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখে পশুপালন করলে অবশ্যই আমরা লাভবান হব। এছাড়াও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চাহিদা মেটাতে বেশ ভূমিকা রাখবে। এই জন্য আমরা পশুপালনে যত্নবান হব।

লেখকের শেষ কথা

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, গবাদি পশুর রোগ এবং টিকা / ভ্যাকসিন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এগুলো জানলে অবশ্যই আমরা উপকৃত হব। এবং পশু পালন করে লাভবান হব।

পাঠকের লক্ষণীয় বিষয় হল, আমাদের এই আর্টিকেলের মধ্যে কোন প্রকার ভুলপরিলক্ষিত হলে অবশ্যই আমাদেরকে অবহিত। আমরা ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করব। এই আর্টিকেল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফিউচার লাইফ আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url